বোরকা হিজাব নিয়ে সব হিসাব মিলে ১ টা মেলানো হিসাব চলেন আবার মেলাই আজ! মোটামুটি সেকুলার বা বাম ঘরানার একটা বড় ক্রিটিক হইলো বোরকা হিজাব এসব নিয়ে।
অথচ এই ভূখণ্ডে মোটামুটি প্রাচীন আমল থেকে বিশেষত উনিশ ও বিংশ শতকের সূচনায় – সম্ভ্রান্ত হিন্দু ও মুসলিম সমাজে নারী চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ প্রচলিত ছিল। পরপুরুষের সামনে মুখ দেখানো, কথাবার্তা বলা, বা একই আঙিনায় উপস্থিত হওয়া ছিল চরম অশোভন ও অশুভ।
ধর্মীয় ভেদাভেদের বাইরে বঙ্গীয় নারীরা কিছু বাই ডিফল্ট রুলসের ভিতর থাকতো তখন। সেইটা হলো ঘোমটা দেয়া, পরপুরুষ এলে আড়ালে চলে যাওয়া, অতিথি থেকে দূরে থাকা, ক্ষেত্রবিশেষে নারীর বাড়ির সীমানা থেকে বাহিরে না আসা।
এখন তো যেকোনো বাড়িতে কেউ এলে হুটহাট বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু তখনকার সময়ে এটি ছিলো দুর্লঙ্ঘনীয় অপরাধ। অপরিচিত কেউ বাড়ির পুরুষ মানুষের অনুপস্থিতিতে বা অনুমতি ব্যতিরেক বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশ করা স্বপ্নেও কল্পনা করতো না। বাড়ির অন্দরে পরিবারের বাহিরের পুরুষ তো দূরের কথা, এমনকি বহু সময় পরিবারের কিছু দূর সম্পর্কের পুরুষ প্রবেশও নিষিদ্ধ ছিল।
তৎকালীন সময়ে প্রতিটি বাড়িতে দহলিজ থাকতো। অতিথিরা এসে সেখানেই আসন গ্রহন করতেন। পরে অতিথির গ্রহনযোগ্যতা সাপেক্ষে তাকে বাড়ির নির্দিষ্ট পরিসীমা পর্যন্ত এক্সেস দেয়া হতো।
মোটামুটি যার যতটুকু সামর্থ্য সেভাবেই এই বাই ডিফল্ট রুলস গুলো মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতো।
এই বাস্তবতা আমরা সবচেয়ে স্পষ্ট দেখতে পাই তৎকালীন সময়ের সাহিত্যিক বর্ণনাগুলোতে। বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথসহ তৎকালীন লেখকদের লেখায় প্রতিনিয়ত উঠে এসেছে ঘোমটা ও অন্তঃপুর-প্রথার কঠোরতা।
যেমন শরৎচন্দ্র তার শ্রীকান্ত উপন্যাসে লিখেছেন –
“বড়-বাড়ির মেয়েদের মুখ দেখা ভার… পরপুরুষ এলে তারা ছায়ার মতো সরে যায়।”
গৃহদাহে আবার মেয়েদের তৎকালীন সামাজিকতা বিবৃত করেছেন এভাবে যে,
“অন্তঃপুরের মেয়েরা অতিথির আগমনে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায়; ছায়াও দেখা যায় না।”
আর চরিত্রহীনে তিনি তুলে ধরেছেন মেয়েদের এক্সেস তখন কতোটা সীমিত ছিলো সেটার চিত্র,
“মেয়েদের রাস্তাঘাটে দেখা যাওয়া তখনও অশোভন বলিয়া গণ্য হইত।”
বঙ্কিমচন্দ্রের বিষবৃক্ষ রচনায় উদ্ধৃত করেছেন এভাবে যে
“পুরুষের পায়ের শব্দে ভিতরের ঘরে সশব্দে দরজা বন্ধ হইল।”
এমনকি তখন দারোয়ান, পুরোহিত, জমিদারের কর্মচারীদের সামনেও নারীরা আসতে পারতো না। কৃষ্ণকান্তের উইল এ সেটা ফুটে উঠেছে
“দারোয়ান উঠানে পা রাখিতেই বউ-ঝিরা ঘোমটা টানিয়া অন্তঃপুরে মিলাইয়া গেল।”
এটাই শেষ না, এরচেয়ে বড় বিধিনিষেধ ফুটে উঠেছে সেসময়ের লেখনীতে। আনন্দমঠে লিখেছেন
“পরপুরুষের দৃষ্টি নারীর জন্য লাঞ্ছনা বলিয়া গণ্য হইত; তাদের চলাচল গৃহের বাহিরে ছিল না।”
মোটামুটি ২ জন তৎকালীন সময়ের লেখকদের বর্ননায় এই ছিলো তখনকার সময়ে হিন্দু নারীদের পরিস্থিতি। অভিজাত ঘরে অন্তঃপুর প্রথা খুব কঠোরভাবে মানা হতো। আর সামাজিক মর্যাদা অনুসারে নিদেনপক্ষে ঘোমটা টানা আবশ্যক ছিলো সকল ক্ষেত্রে।
সুতরাং আমাদের বঙ্গীয় সমাজে নারীদের শালীনতা বজায় রেখে চলা কোনো হুটহাট করে চাপিয়ে দেয়া প্রথা নয়। এখানে প্রাচীন আমল থেকেই বই ডিফল্ট ধর্মীয় প্রেক্ষাপটের বাইরেও শালীনতার চর্চা হয়ে আসছে। বরং এক্ষেত্রে অনেক বাড়াবাড়ি ও হয়েছে।
তৎকালীন সময়ে হিন্দু নারীরা গঙ্গাস্নান করতেন পালকিতে চড়ে। সমগ্র পালকি থাকতো কালো পর্দায় ঘেরা। পালকি সহ গঙ্গা থেকে ডুবিয়ে সে অবস্থাতেই আবার অন্তঃপুরে নিয়ে আসা হতো। এতটাই দুর্লঙ্ঘনীয় প্রথা ছিলো তখনকার সময়ে।
মুসলমানদের বাড়ির মেয়েরা সফরে বের হলে তখনও কঠোরভাবে মানা হতো পর্দাপ্রথা ঝাঁপি, পালকি, ঘোড়ার গাড়ি বাহন যেটাই হোক না কেন সেটা ঢাকা থাকতো কালো কাপড় বা শক্ত কোনো আবরনে।
মুসলমানদের মাঝে পর্দাপ্রথা তখন কেবলমাত্র ধর্মীয় বিধিবিধান নয়, সমাজে পরিবার-সম্মান, বংশমর্যাদার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল বাড়ির মেয়েদের চলাফেরা।
পরিচারক, খাজনা আদায়কারী, কাজের লোক, এমনকি শিক্ষক বা মৌলভীর সাথেও মেয়েরা সরাসরি কথা বলতে পারতেন না। কথাবার্তা সাধারণত পরিবারের পুরুষ বা নিরুপায় ক্ষেত্রবিশেষে পর্দাপ্রথা মেনে বয়স্কা গৃহিণীদের মাধ্যমে হত।
মীর মশারফ হোসেনের কালজয়ী উপন্যাস ‘বিষাদ সিন্ধু’তে মুসলিম অভিজাত সমাজের নারীদের পর্দার কথা সুস্পষ্ট ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন,
“জেনানার নারীগণ বাইরের পাষাণদেয়ালের আড়াল ছেড়ে কখনও আসেন না; পরপুরুষের দৃষ্টি তাঁদের প্রতি পড়া লাঞ্ছনা বলিয়া গণ্য হয়।”
সৈয়দ মুজতবা আলী তার স্মৃতিচারণে সিলেটি মুসলিম সমাজে নারীর পর্দার বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“নারীরা বাইরে আসে না; আমার মা-খালারা কখনও পরপুরুষের সামনে উপস্থিত হননি, অতিথি এলেই আড়াল হতো অন্য সবকিছু।”
শরৎচন্দ্র তাঁর ‘পল্লীসমাজ’ রচনায় লিখেছেন,
“মুসলমানের বাড়িতে মেয়েদের দেখা মুশকিল; পর্দা এত কড়া যে দাওয়াতেও তারা আলাদা আসরে থাকে।”
অর্থাৎ তৎকালীন বাংলার সমাজে পর্দা শুধু ধর্মীয় না; এটা বাংলার আবহমান সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে মিলিত হয়ে গিয়েছিল। সকল সম্ভ্রান্ত শ্রেণিতে পর্দা প্রায় একই ছিল, শুধুমাত্র পার্থক্য ছিলো ধর্মীয় ব্যাখ্যায়।
মোটামুটি এভাবেই চলে আসছিলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। একটা সময় সময়ের আবর্তে পরিবর্তন হয় অনেক কিছু। কিন্তু বঙ্গীয় নারীদের সেই বাই ডিফল্ট পর্দার ক্ষেত্র শিথিল হলেও মিলিয়ে যায় নি। এখনো দেখবেন পরপুরুষের সামনে ধর্মীয় ভেদাভেদের বাইরে নারীরা শালীনতা বজায় রাখতে কিছুটা হলেও চেষ্টা করে। বড় আঁচলের শাড়ি হয়তো বিলুপ্ত প্রায়, ওড়নার চল এসেছে। নানাবিধ অস্থিরতার মাঝে বয়োজ্যেষ্ঠদের সামনে ঘোমটা টানার প্রচলন এখনো রয়ে গিয়েছে। উচ্ছৃঙ্খলতা হয়তো একটু বেশি। তবে হারিয়ে যায়নি একদম শালীনতাবোধ।
কিন্তু সমস্যা সেখানে না, সমস্যা হলো একজন মুসলিম নারী যখন বোরকা, হিজাবে নিজেকে আবৃত করে চলেন তখন পারিপার্শ্বিক কিছু মানুষের কথাবার্তা। তারা এটাকে ক্রিটিক করেন, সনাতন সমাজের সাথে মিলিয়ে হেট স্পিচ ছড়ান অনেক সময়ে।
কিন্তু তাঁরা বেমালুম ভুলে যান পর্দা ইসলামের আবশ্যকীয় একটি বিধান। একজন মুসলিম মাত্রই তাকে ধর্মীয় মোতাবেক পর্দার বিধান মানতে হবে। এটা তার অধিকার। প্রতিটি ধর্মেই বাই ডিফল্ট রুলস থাকে যেগুলো মানা সেই ধর্মের মানুষের মৌলিক অধিকার। কারো নূন্যতম কোনো অধিকার নেই সেখানে হস্তক্ষেপ করার।
আর বঙ্গীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে শালীনতা বজায় রেখে চলা নতুন কিছু না। ধর্মীয় ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে এখানে শালীনতার চর্চা হয়েছে আবহমানকাল ধরে। এটাই আমাদের চলে আসা বাংলার সংস্কৃতি। এটাকে অস্বীকার করলে আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য প্রশ্নের মুখে পড়ে। হ্যা তখনকার সময়ে এটা নিয়ে ক্ষেত্রবিশেষে বাড়াবাড়ি হয়েছে। এটা ধ্রুব সত্যি। সেসব নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু বঙ্গনারীদের শালীনতা বজায় রেখে চলার যে ঐতিহ্য, সেটাকে ক্রিটিক করা মানে নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। সুতরাং যারা এটা করে তারা ইতিহাসকে এড়িয়ে যান। বা, না জানার ভান করেন। এটা মূলত ইসলাম বিদ্বেষ। যারা হিজাব, বোরকা নিয়ে ক্রিটিক করে। তাদের একটা সহজ মিল দেখা যায় সেটা হলো সবাই কোনো না কোনোভাবে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষন করে। তাঁরা ইসলামকে সদাসর্বদা ক্রিটিক করে চলেন। ইসলামিক বিধিনিষেধ কে তাঁরা হাস্যরসের বিষয়ে নিয়ে উপহাস করেন। সুতরাং তাদের মূল সমস্যা যতটা না হিজাবে তার চেয়ে বেশি ইসলামে।


