শহীদ প্রেসিডেন্ট ড. মোহাম্মদ মুরসি ও মিসরের রক্তাক্ত বিপ্লব

শহীদ ড. মোহাম্মদ মুরসি সুপ্রাচীন মিসরের ইতিহাসে প্রথম ও একমাত্র গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তবে এটি ছাপিয়ে তাঁর আরও একটি পরিচয় আছে, সেটি হলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম সর্বোচ্চ সাফল্য তিনি অর্জন করেছিলেন। নানা ধরনের বাধা, বিপত্তি, প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি মিসরের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসীন হতে পেরেছিলেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় বিজয় ছিল।

২০১১ সালের আরব বসন্ত যখন মিসরের বুকে আছড়ে পড়ল, তখন তার মতো নেতারাই জনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। স্বৈরশাসক মুবারকের পতনের পর যে গণতান্ত্রিক ধারার সূচনা হয়েছিল, তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন মোহাম্মদ মুরসি।

কিন্তু সেটি খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। প্রতিনিয়ত তাঁর এই পথচলা হয়ে উঠতে থাকে কণ্টকাকীর্ণ। একদিকে মুবারক আমলে আসন গেঁড়ে বসা বিচারকদের ষড়যন্ত্র, অন্যদিকে বন্ধুবেশী শত্রু আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সুকৌশলে সামরিক বাহিনীতে অস্থিরতা সৃষ্টি, অধিকাংশ মুসলিম দেশ এবং ইসরায়েল-পশ্চিমা চক্রান্ত তাঁকে আটকে রাখতে উঠে পড়ে লাগে।

ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য মিসরে স্বাভাবিক শাসন থাকা ছিল অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। মুরসি ক্ষমতায় এসেই স্বল্প সময়ের মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হামাস ও ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ানো এবং গাজার জন্য সীমান্ত আংশিক খুলে দেওয়া, সিনাই উপদ্বীপে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা, মিসরের অর্থনীতিকে আত্মনির্ভর করতে উদ্যোগ নেওয়া, মোবারক আমলের সরকারি আমলা ও সেনাবাহিনীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ।

এসব সিদ্ধান্ত তাঁর শত্রুরা ভালো চোখে দেখেনি। মিসরে ইসলামী আন্দোলন সফল হলে সেই ঢেউ সৌদির দুয়ারে লাগবে না—এই নিশ্চয়তা কারও ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমাপন্থী রাজতন্ত্রের জন্য মুসলিম ব্রাদারহুডের এই বিজয় ছিল দুঃস্বপ্নের মতো।

অন্যদিকে, ইসরায়েল বরাবরই মিসরের নেতৃত্বে এমন একজনকে চেয়েছে, যিনি হবেন অনেকটা আওয়ামী লীগের মতো—যেমন, শান্তিচুক্তির নামে ফিলিস্তিনিদের দমন ও গাজা সীমান্তে অবরোধে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু গতানুগতিক ধারা পাল্টে মুরসি হয়ে গেলেন সেই ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত!

আর পশ্চিমাদের তো ইসলামী আন্দোলনের প্রতি স্বাভাবিক এলার্জি আছেই।

সব মিলে এবার সিসিকে ক্রীড়ানক বানিয়ে শুরু হয় মুরসিকে উৎখাতের এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। মুরসির এই বিজয়ের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায়, যুগের পর যুগ ধরে নির্মম নির্যাতনে পিষ্ট মুসলিম ব্রাদারহুড যখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছিল, তখনই আসে প্রলয়ংকারী সেই অবস্থা।

২০১৩ সালের ৩ জুলাই, মাত্র এক বছরের মাথায় সৌদি-ইসরায়েল-মার্কিন সমর্থিত সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।

এরপর শুরু হয় তাঁর ওপর ভয়াবহ নির্যাতন। কারাবন্দি অবস্থায় বছরের পর বছর তাকে রাখা হয় একক সেলে, যেখানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পর্যন্ত ছিল না। পরিবারের সদস্য ও আইনজীবীদের সঙ্গে দেখা করতে দেওয়ার সুযোগ ছিল না।

তিনি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও কিডনি রোগে ভুগছিলেন, কিন্তু তাঁকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়।

শুধু মুরসির ওপর নয়, মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতাকর্মীদের ওপরও আবার শুরু হয় নির্যাতনের স্টিমরোলার। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে এমন সব অভিযোগে মামলা দেওয়া হয় (বাংলাদেশের গায়েবি মামলার মতো), যেগুলোর কোনো সত্যতা ছিল না।

বিচার ব্যবস্থা ছিল সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল। ‘মাস ট্রায়াল’ নামে একদিনে শত শত মানুষকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন দেওয়া হতো। কোনো প্রকৃত তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছিল না। ঠিক আওয়ামী আমলের ক্যাঙ্গারু কোর্টের মতো।

তারপরও অত্যাচারের পাহাড় টপকে, মিসরের লাখো জনতা কায়রোর ‘রাবা আল-আদাওয়িয়া’ চত্বরে শান্তিপূর্ণভাবে মুরসির ফিরে আসার দাবিতে অবস্থান করছিল। তখন সেনাবাহিনী সরাসরি গুলি চালিয়ে প্রায় এক হাজারের বেশি মানুষকে একদিনেই হত্যা করে। এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ ইতিহাসের পাতায় ‘Rabaa Massacre’ নামে পরিচিত হয়ে আছে। এভাবেই ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে আবারও সর্বশক্তি প্রয়োগ করে মুসলিম ব্রাদারহুডকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে সচেষ্ট হয় বিদেশি মদদপুষ্ট এই গোষ্ঠী।

এভাবেই বয়ে যায় সময়। অত্যাচারের স্টিমরোলারে পিষ্ট হতে থাকে সাইয়েদ কুতুব, ইমাম হাসানুল বান্নার উত্তরসূরিরা।

২০১৯ সালের ১৭ জুন, আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেই বক্তব্য রাখছিলেন মুরসি। প্রায় ২০ মিনিট তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। নির্যাতনে দুর্বল মুরসি তাঁর প্রাণশক্তির সর্বোচ্চ দিয়ে কণ্ঠ উচ্চকিত রাখেন মিসরের প্রতি, ইসলামের প্রতি। এ সময় হঠাৎ করে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কোনো চিকিৎসা ছাড়াই দীর্ঘ সময় অচেতন অবস্থায় ওখানেই ফেলে রাখা হয়। ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাঁকে ফেলে রেখে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। সাইয়েদ কুতুব, ইমাম হাসানুল বান্নার মতো তিনিও শামিল হন সেই শহীদি কাফেলায়।

সাইয়েদ কুতুব, ইমাম হাসানুল বান্নার জ্বালিয়ে যাওয়া ইসলামী আন্দোলনের পুনর্জাগরণের ঝাণ্ডাবাহী এক বীর এভাবেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। তবুও নিভে যায়নি পুনর্জাগরণের সেই দীপ্তিময়তা। মুসলিম ব্রাদারহুড শত নির্যাতন সহ্য করে এগিয়ে চলেছে আল্লাহর রাহে।

মিসরের ইসলামী আন্দোলন এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক মিল রয়েছে। মিসরের সেই বিপ্লব থেকে আমাদের শেখার অনেক বিষয় আছে। আরব বসন্ত, মুরসির সময়কাল, মুসলিম ব্রাদারহুডের ওপর চলা অবর্ণনীয় নির্যাতন আমাদের আগামীর দিনগুলো কেমন হতে পারে, তার একটি পরিষ্কার ছবি তুলে ধরে। আমরা ইসলামী বিপ্লব যত সহজে বলে ফেলি, এটি এত সহজ নয়। এই বিপ্লবের সঙ্গে লেগে আছে সহস্র আব্দুল মালেক, মুরসিদের অবর্ণনীয় ত্যাগ আর শাহাদাতের রক্তঢালা ইতিহাস।