শাপলা চত্বর বনাম হেফাজত

শাপলা চত্বর বনাম হেফাজত

শিরোনামটি হয়তো একটু ভিন্নরকম বা অদ্ভুত লাগতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে শাপলা চত্বর এর সেই ঐতিহাসিক সমাবেশ তো হেফাজতের ই ছিলো। তবে এখানে শাপলা চত্বর বনাম হেফাজত হলো কেন! আশা করি নিচের লেখাগুলো এবং তথ্যসূত্র গুলো এই শিরোনাম এর যথার্থতা তুলে ধরবে।

২০১৩ সালের ৫ ই মে, ইতিপূর্বে শাহবাগের সেই তাণ্ডবলীলা ও কয়েকজন ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগসহ ১৩দফা দাবি নিয়ে শাহবাগ অভিমুখে লংমার্চ ও ঢাকা অবরোধের মতো কর্মসূচি পালন করে হেফাজতে ইসলাম।

বরাবরের যেকোনো আন্দোলনের মত এখানেই পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পান্ডারা অযাচিত হস্তক্ষেপ করে দিনের পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে ফেলে। শান্তিকামী হেফাজত কর্মীদের উপর হামলা হলে তারাও পালটা জবাব দেয়। ফলে ব্যাপক সহিংসতা হয়।

এরপর রাত নামে, সারাদিনের শ্রান্ত মুজাহিদেরা ঘুমিয়ে পড়ে নিদ্রার কোলে। আপাত দৃষ্টিতে সেই রাত স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে সেটা অন্যান্য রাতের মত স্বাভাবিক ছিলো না। এই রাতের তুলনা একমাত্র সেই ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের ভয়াল রাতের সাথে তুলনীয়।

সারাদিনের পুলিশ ও সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার হওয়ার পর হেফাজত কর্মীরা ভাবতে ও পারে নি যে রাতে নেমে আসবে এক পাহাড়সম নির্মমতা। হেফাজতের অদক্ষ নেতৃবৃন্দ কোনোরকম পাহারার ব্যবস্থা বা দিকনির্দেশনা ও দেন নি।

রাত সাড়ে দশটার দিকে, পুলিশ নিরাপত্তা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের প্রধান শাহ আহমদ শফিকে লালবাগ মাদ্রাসা থেকে নিয়ে শাপলা চত্বরের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু কিছুটা পথ এসেই অসুস্থ এবং নিরাপত্তার অভাবের কথা বলে শাহ আহমদ শফি ফিরে যান। তিনি আর আসেননি শাপলা চত্বরে।

ফলশ্রুতিতে সকল জনতা স্বাভাবিকভাবেই ঘুমিয়ে যায়।

তখন রাত সোয়া একটা, শুরু হয় আলোচিত সেই রাতের অভিযানের প্রস্তুতি। পুলিশ, র‍্যাব,বিজিবির হাজার হাজার সদস্য ঘিরে ফেলে অবস্থানকারীদের। এরপর শুরু হয় সেই অজানা রাতের ইতিহাস। সংবাদমাধ্যম ব্যর্থ হয় সত্য সংবাদ তুলে ধরতে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতিতে উঠে আসে নানা নির্মমতা। তবে সেগুলো মূলধারার মিডিয়া পাড়ায় আসে না।

সেদিনের রাতের অভিযানে নিহতের সংখ্যা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছিল।

  • আড়াই হাজারের মতো নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলছিল বিভিন্ন দল।
  • পুলিশ বলেছিল, অভিযানের সময় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা গিয়েছিল।
  • স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ই এবং ৬ই মে দু’দিনে সারাদেশে ২৮ জনের নিহত হওয়ার কথা বলেছিল।

তবে লাশের ওপর দিয়ে ভারী যানবাহন চালিয়ে দেয়া এবং ট্রাকভর্তি লাশ সরিয়ে নেয়ার দৃশ্য বিভিন্ন আলোকচিত্রে ও ভিডিওতে দেখা গিয়েছে।

সংবাদমাধ্যম বিবিসি তাঁর একটি প্রতিবেদনের শেষাংশে সেদিনের সেই নির্মমতা তুলে ধরেছে ঠিক এভাবে,

ভোর পাঁচটা,পুরো মতিঝিল এলাকার পরিবেশটা একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত এলাকার মতো মনে হয়েছিল। আগের দিনের সহিংস বিক্ষোভের অনেক চিহ্ন আশেপাশে ছড়িয়েছিল।1

তখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলেও এই উক্তির মাধ্যমে অনেকটা উঠে এসেছে সেদিনের নির্মমতা।

পরবর্তীতে হেফাজত আঁতাত করে সরকারের সাথে। শহীদের রক্তের সাথে বেইমানী করে গোপন বৈঠক করে, সমাবেশ করে, শোকরানা মাহফিল করে। মূলত বয়োবৃদ্ধ আল্লামা শাহ আহমদ শফী হুজুরকে ব্যবহার করতে শুরু করে এক দুষ্টচক্র। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো তাঁরই ছেলে আনাস মাদানী ও গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন

হেফাজত নিয়ে কথা উঠলে এখানে আনাস মাদানীমুফতি রুহুল আমীন বিশেষ জায়গা দখল করবেন। সবার আগে আনাস মাদানী কে নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। মুফতি রুহুল আমীন এর অবদান নিচে বিবৃত আছে। আনাস মাদানী কে নিয়ে দৈনিক ইনকিলাব এর একটি প্রতিবেদনে ঠিক এভাবে বিবৃত আছে কথা,

মাওলানা আনাস মাদানী। আল্লামা শাহ আহমদ শফীর পুত্র। এ পরিচয়েই দোর্দন্ড প্রতাপ। দেশের প্রাচীনতম হাটহাজারী মাদরাসায় তার কথাই ছিল শেষ কথা। যখন যাকে খুশি তাকে দেখে নেওয়া এবং সাইজ করাতে তিনি ছিলেন বেপরোয়া।2

মূলত ৫ ই মে এর পর উত্থান হয় হয় আনাস মাদানীর। সরকারের সাথে সখ্য ও হাটহাজারী ও রাঙ্গুনিয়ায় রেলের জমিসহ সরকারি-বেসরকারি জমি দখলের অভিযোগ উঠে আল্লামা শফী পুত্রের বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, পিতার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে মাদরাসায় নানা অনিয়ম করছিলেন তিনি।3 45

হেফাজতে মূল প্রাণশক্তি ছিলো মাদ্রাসার তালেবে ইলম ও তৌহিদি জনতা। তারা পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আর আল্লাহর প্রতি দৃঢ় আস্থা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ময়দানে। কিন্তু আফসোস হেফাজতের অদক্ষ ও লোভী নেতৃবৃন্দ তাদের কে বিমুখ করে দিল। এত বড় কর্মীবাহিনী কে যথাযথ ব্যবহার করার মত সক্ষমতা তারা তৈরি করতে পারলো না। তারা শুধু লোকসংখ্যা দেখে বলীয়ান হয়েছিলো। দক্ষতা বিহীন ও আল্লাহর প্রতি আস্থাবিমুখ হয়ে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস হেফাজত নেতাদের সামনের দিনের পথচলাকে মসৃণ করেনি।

ফলে এখানে সাধারন জনতাকে দোষ না দিয়ে হেফাজত নেতাদের নিজেদের আত্মসমালোচনা করা উচিত আগে। যেটা তারা কখনো ই করেন নি। প্রকারান্তরে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে হেফাজত ইসলামের নেতা এবং লীগের সন্ত্রাসী মিলে একজোট হয়ে এদের সরাসরি হত্যা করেছে। এই দায় হেফাজত নেতারা কখনোই এড়াতে পারেন না। তাদের কোনো পরিকল্পনা ই ছিলো না এই আন্দোলন নিয়ে, বা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে ও তারা কোনো পরিকল্পনা করে উঠতে পারে নি।

হেফাজত নেতারা এইসব নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যার প্রধান কুশীলব। এত বড় একটা গনহত্যার পর ও তারা শহীদের তালিকা, প্রমাণ সংগ্রহ করে রাখা, মামলা কিছুই করে নাই। উল্টো নেতারা গিয়ে স্বৈরাচারী হাসিনা ওয়াজেদকে কওমি জননী বানিয়েছে।6 কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি দেয়ায় হাসিনা ওয়াজেদকে ‘কওমি জননী’ বলে উল্লেখ করেন উত্তরবঙ্গ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের সভাপতি ও গওহরডাঙ্গা মাদরাসার মহাপরিচালক মুফতি রুহুল আমীন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পেতে নড়াইল-১ আসনে মুফতি রুহুল আমীন মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন। সে সময় তিনি মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হলেও ২০২২ সালের ৩১ মার্চ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের নতুন খতিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। 7 এখানে উল্লেখ্য যে এই রুহুল আমীন সবসময় ই আওয়ামী লীগ কে সেবা করে এসেছে। তারপর ও এই পদলেহন কারীকে দলে ভিড়িয়েছিলো হেফাজত।

২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে পুলিশি অভিযানে মৃতের সংখ্যা নিয়ে হেফাজতের নেতারা টুঁ শব্দ না করলেও এটা নিয়ে সবার আগে সরব হয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার। ৬১ জন নিহত হওয়ার কথা প্রকাশ তারা।

ফলশ্রুতিতে তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়।8 প্রতিবেদন প্রকাশের পর সংগঠনটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। সংগঠনটির প্রধান আদিলুর রহমান খান চরম নির্যাতনের সম্মুখীন হন।9

হেফাজতের নেতারা যখন হালুয়া রুটির ভাগ খাচ্ছিল তখন একমাত্র অধিকার সরব হয়ে কথা বলেছিলো।

২৪ এর আন্দোলনে যদি সমন্বয়করা আঁতাত করতেন তাহলে এই আন্দোলন ও সফল হতো না। কিন্তু ডিবির অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, একজন আটক হলে আরেকজন দায়িত্ব নিয়ে তারা আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। তারা একটা প্রোপার ওয়েতে কাজ করে আজকে আন্দোলন সফল করে তুলেছে। কিন্তু হেফাজত এখানে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৩ সালের গনহত্যার পর তাদের সব নেতারা চুপ হয়ে যায়। তারা এত বড় একটি কর্মীবাহিনী কে যথাযথ ভাবে ব্যবহার তো করতেই পারে নি বরং আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর বিপ্লবকে কলঙ্কিত করে আঁতাত করেছে গণহত্যাকারীদের সাথে।

পরবর্তীকালে স্বৈরাচারকে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছে হেফাজত। শহিদ দের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে তারা স্বৈরাচারকে উপাধি দিয়েছে। সাধারন ছাত্ররা যেভাবে পরিপক্ব বিপ্লব করতে পেরেছে সেখানে তারা আঁতাত করেছে।

তাই এখন এসব দায় চাপানোর রাজনীতি হেফাজতের বন্ধ করা উচিত। তাদের উচিত দেরিতে হলেও এখনই ২০১৩ এর শহিদ দের তালিকা, হেফাজত নেতা, পুলিশ, সরকার সহ যারা যারা এই কাজে জড়িত ছিলো তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনার জন্য মামলা দায়ের সহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া।

এ ব্যাপারে অযথা বিভক্তির মন্তব্য না করে অধিকারের সাথে যোগাযোগ করে তাদের থেকে ডাটা নিয়ে ও পাশাপাশি মাঠপর্যায় থেকে তালিকা সংগ্রহ করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া। এটা করতে পারলে ২০২৪ এর গনহত্যার সাথে সাথে ২০১৩ এর সেই নির্মম গনহত্যার দায়ভার ও হাসিনাকে দেয়া যাবে।

হেফাজতের প্রতি এখনো আহ্বান আপনারা শুধু দায়িত্ব নিয়ে শুরু করেন। পুরো দেশ এগিয়ে আসবে। তা না করে আবার দলাদলি করলে আরেকবার শহিদ দের রক্ত কে আপনারা কলঙ্কিত করবেন।

তথ্যসূত্রঃ

  1. https://rb.gy/i65iym ↩︎
  2. আনাস মাদানী-যার কথাই ছিল শেষ কথা (dailyinqilab.com) ↩︎
  3. আনাস মাদানী-যার কথাই ছিল শেষ কথা (dailyinqilab.com) ↩︎
  4. হেফাজতে ইসলাম ও আওয়ামী রাজনীতি (chhatrasangbadbd.com) ↩︎
  5. কে সেই আনাস মাদানি? কি তার পরিচয়? – Komashisha ↩︎
  6. যে কারনে প্রধানমন্ত্রীকে ‘কওমী জননী’ উপাধি দেয়া হল (dailynayadiganta.com) ↩︎
  7. ‘কওমি জননী’ উপাধি দেয়া সেই মুফতি হচ্ছেন বাইতুল মোকাররমের খতিব? (amarsangbad.com) ↩︎
  8. মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নিবন্ধন বাতিল – DW – 07.06.2022 ↩︎
  9. অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান গ্রেপ্তার – BBC News বাংলা ↩︎