মুসআব ইবনে উমাইর (রা) আত্মত্যাগের এক অমর প্রতীক

Photo of author

আরশাদ আল গালিব

তিনি যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন মক্কার মানুষজন তখন বুঝতো এ পথ দিয়ে মুসয়াব যাচ্ছে! ধনাঢ্য মায়ের অঢেল সম্পদ আর প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। চমৎকার সব পোশাক, উন্নতমানের সুগন্ধি সহ বিলাসের যাবতীয় বিষয়ে অবাধ বিস্তৃতি ছিলো তার।

এদিকে মক্কা জুড়ে তখন ইসলামের দাওয়াত চলছে রাসুল (সা) ও গুটিকয়েক মুষ্টিমেয় সাহাবায়ে কেরামদের নিয়ে। মুসয়াব ও একদিন চলে গেলেন রাসুল (সা) এর দরবারে। কোরআনের বাণী আর রাসুল (সা) মুগ্ধতায় সপে দিলেন নিজেকে, ইসলাম কবুল করে নিলেন। প্রথমে কিছুদিন গোপন থাকলেও এরপর প্রকাশ হয়ে গেল মুসয়াব (রা) এর ইসলাম গ্রহনের বিষয়টি। ঘরে আটকে রাখা হলো মুসয়াব (রা) কে। কিন্তু যে পাখি মুক্ত আসমানের দিশা খুঁজে পেয়েছে তাকে কি আর আটকে রাখা যায়!

একদিন শতচ্ছিন্ন তালি দেয়া জীর্ণ শীর্ণ একজন লোক হেঁটে আসছে। গায়ে তার দারিদ্র্যের প্রলেপন। রাজকীয় ঐশ্বর্য ঢাকা পড়েছে জীর্ণ পোশাকের তালিতে। তবে সমগ্র শরীরে ঈমানী জজবার অপরিমেয় দীপ্তি বিচ্ছুরিত হচ্ছে সাহাবায়ে কেরাম পরিবেষ্টিত রাসুল (সা) কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

অমানবিক নির্যাতনে বিপর্যস্ত অন্যান্য সাহাবিদের মতো মুসয়াব (রা) কে ও রাসুল (সা) হাবশায় হিজরত করতে বললেন। কিন্তু হিজরতের পর মন টিকলো না মুসয়াব (রা) এর। আল্লাহর নির্দেশিত পথ আর রাসূলের দিকনির্দেশনায় যে সঁপেছে প্রাণ সে কি আর স্থবির থাকতে পারে! মুসয়াব (রা) আবার ফিরে এলেন মক্কায় রাসুল (সা) সান্নিধ্যে।

আকাবার শপথের পর দাওয়াতী কাজে রাসুল (সা) মুসয়াব (রা) কে মদীনায় পাঠালেন। মুসয়াব (রা) ব্যক্তিগত মাধুর্যতা আর চমৎকার আচরণে প্রচার করতে লাগলেন মহান আল্লাহর বাণী ও রাসুল (সা) এর জীবনাদর্শ। মদীনায় মুসলমানদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেল।

রাসুল (সা) মদীনায় হিজরত করলেন। কিছুদিন পর বেজে উঠলো বদর যুদ্ধের রণডঙ্কা। প্রথম যুদ্ধে অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করলো ঈমানদীপ্ত মুসলমানরা। মুসয়াব (রা) বীরত্বের সাথে লড়াই করলেন।

এরপর বেজে উঠলো উহুদের সেই করুণ সুর। যেখানে মুসলমানদের একটু অসাবধানতায় প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিলো সুনিশ্চিত বিজয়। ছন্নছাড়া মুসলিম বাহিনী। কুরাইশরা ঘিরে ফেলেছে রাসুল (সা)। ময়দানে তখন যুদ্ধের ঝান্ডা হাতে মুসয়াব (রা)। রাসুল (সা) কে মুশরিকরা ঘিরে ফেলছে দেখে অমিতবিক্রমে এক হাতে ইসলামি ঝান্ডা আর আরেক হাতে কোষমুক্ত তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। তার বীরদর্পে ভড়কে গেল মুশরিক বাহিনী। সফল হলেন মুসয়াব (রা)। রাসুল (সা) এর দিক থেকে কাফির দের মনোযোগ সরিয়ে নিতে সমর্থ হলেন তিনি। এমনি একটা সময় কাফির বাহিনী ঘিরে ফেললো তাকে। তখনও গগনবিদারী আল্লাহ আকবার তাকবির আর তলোয়ারের ঝলকানিতে ত্রস্ত করে তুলছিলেন কাফিরদের। হঠাৎ করে কফির ইবনে কামিয়াহ তার ডান হাতে আঘাত করে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ডান হাত। মুসয়াব (রা) উচ্চকিত কণ্ঠে বলে উঠলেন

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, তাঁর পূর্বেও অনেক রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন।

(সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৪৪)

ডান হাতের ঝান্ডা এবার বাম হাত দিয়ে উঁচু করে ধরলেন তিনি। নরাধম কামিয়াহ আবার বাম হাতে আঘাত করে বিচ্ছিন্ন করে দিল বাম হাত। আবারও মুসয়াব (রা) পুনরাবৃত্তি করলেন সেই আয়াত। এবার দুই বাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন ইসলামী ঝান্ডা।

কামিয়াহ এবার তলোয়ার ছেড়ে বর্শা দিয়ে আঘাত করে শহীদ করে দিলেন মুসয়াব (রা)। জীবনের শেষ সময়ে এসেও তিনি উঁচু করে রেখছিলেন ইসলামী ঝান্ডা। ইসলামের জাগরণ চালিয়ে যেতে ও রাসূল (সা) এর নিরাপত্তায় শাহাদাতের অমীয় সূধা পান করলেন তিনি।

এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি আবার হয়েছিলো মূতার যুদ্ধে। মুসলিম সেনাপতি জাফর ইবনে আবু তালেব (রা) জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে উঁচু করে রেখেছিলেন ইসলামী ঝান্ডা।

যুদ্ধ শেষ। ময়দান থেকে খুঁজে বের করা হলো মুসয়াব (রা) এর লাশ। নৃশংস কাফিরদের নির্মমতায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছিলো একসময়ের ধনাঢ্য দুলাল মুসয়াব (রা) এর শহীদি দেহ। যিনি তার সর্বস্ব সমর্পণ করেছিলেন আল্লাহ ও তার রাসূলের মাঝে।

উহুদ যুদ্ধের শহীদদের কবরস্থান:
এখানে শায়িত আছেন ইসলামের ইতিহাসের বীর যোদ্ধারা, যারা উহুদ যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। তাদের আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে মুসলিম উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করে আসছে।

ইমাম তিরমিযীর বর্ণনায় এভাবেই ফুটে উঠেছে মুসয়াব (রা) এর দাফনের দৃশ্য,

মুসআব ইবনে উমাইর (রা) মাত্র একখানা কাপড় ছাড়া আর কোনো সম্পদই রেখে যাননি। (তার মৃত্যুর পর) লোকেরা ঐ কাপড়খানা দিয়ে তার মাথা ঢাকলে তার পা দুটি বের হয়ে যেত, আবার তা দিয়ে তার পা দুটি ঢেকে দিলে তার মাথাটি অনাবৃত হয়ে যেত। সে সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কাপড়টি দিয়ে তার মাথা ঢেকে দাও এবং তার পায়ের উপর ইযখির ঘাস বিছিয়ে দাও। (তিরমিযী, বাবু মানাকিবু মুসআব ইবনে উমাইর রা.)

সময় কেটে গিয়েছে, কেটেছে যুগান্তর। তবুও মলিন হয় নি মুসয়াব (রা) নাম, ও ইসলামের জন্য তার আত্মত্যাগ। শত অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে, জাগতিক সকল ভোগবিলাস কে ছূড়ে ফেলে জীবনের শেষ রক্তবিন্দু ইসলামের জন্য বিলিয়ে দেয়া মুসয়াব (রা) চির-অমলিন হয়ে আছেন মুসলমানদের গৌরবগাঁথায়। মুসআব ইবনে উমাইর (রা)-এর জীবন মুসলমানদের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের প্রতি ভালোবাসা জাগতিক প্রাচুর্যের চেয়ে অনেক বড় হতে পারে। তাঁর আত্মত্যাগ ও সাহসিকতা আজও মুসলিম জাতির গৌরবগাঁথায় চিরজাগরুক। মুসয়াব (রা) সহ সকল সাহাবায়ে কেরামদের আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা। সাময়িক সমস্যায় অস্থির চিত্ত কিংবা পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যাওয়া আমাদের জন্য উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সাহাবায়ে কেরামদের এসব আত্মত্যাগ।

মুসআব (রা.)-এর জীবনী থেকে অনুপ্রাণিত হতে এবং তাঁর জীবন সম্পর্কে আরো জানতে পড়তে পারেন। এ লেখাটিও ব্যক্তিগত পড়া ও এসব সূত্র থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রচিত:

Leave a Comment